শিক্ষা ও শিক্ষকতা। পর্ব : ২১-৩০।
২১।
নিজের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে কোন ছাত্রকে সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত নয়। এতে বহুমুখী সমস্যা তৈরি হবার সুযোগ থাকে। তবে কোন ছাত্র যদি স্বেচ্ছায় সংশোধন হবার লক্ষ্যে কোন শিক্ষকের কাছে পরামর্শ চায়—সেটা প্রশংসনীয়। কিন্তু শিক্ষক নিজ থেকে কোনো এক ছাত্রকে সংশোধনের জন্য উঠেপড়ে লাগা উচিত নয়।
২২।
একজন আদর্শ শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়গুলো খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবে ছাত্রদের বুঝাতে পারেন। এবং অন্তরে ছাত্রদের বুঝাবার মনমানসিকতাও লালন করেন। এমন শিক্ষকের দারসে উপস্থিত সকল ছাত্র তার দারস খুব সহজেই বুঝতে সক্ষম হয়। ছাত্রদের বুঝাবার মানসিকতা কেমন থাকা চাই তার একটা দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যাক-
রবি বিন সুলায়মান, যিনি ইমাম শাফেয়ী রহ. এর বিশিষ্ট শিষ্য ছিলেন। তিনি বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. আমাকে বলেছেন-
يا ربيع! لو قدرت أن أطعمك العلم لأطعمتك إياه
হে রবি! যদি আমি পারতাম, তাহলে ইলম তোমাকে লোকমা বানিয়ে খাইয়ে দিতাম। সূত্র : জামি বয়ানিল ইলম, পৃ. ১৭১।
২৩।
ছাত্রের উপর শিক্ষকের যত হক রয়েছে—সে ব্যাপারে আমরা দারসে, বয়ানে ও উঠা-বসায় ছাত্রদের যথেষ্ট সচেতন করবার চেষ্টা করি। কিন্তু শিক্ষকের উপর ছাত্রের যত হক রয়েছে—সে ব্যাপারে আমরা অনেকটা উদাসীনতার পরিচয় দেই। এবং এ বিষয়ে আমাদের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো পড়াশুনাও থাকে না।
২৪।
শিক্ষকের মাঝে উদারতা ও কঠোরতা দুটিই সমানভাবে থাকতে হয়। দুটির কোনো একটি দুর্বল হয়ে গেলে ধীরে ধীরে শিক্ষকের ভাবগাম্ভীর্যের অবনতি ঘটতে থাকে।
২৫।
একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রদের সাথে রাগ করে কথা বন্ধ করা ও দারসে না যাওয়া ইত্যাদি আচরণগুলো যথাসাধ্য এড়িয়ে চলেন।
এ বিষয়ে একটি ঘটনা লক্ষ্য করা যাক__
ইমাম সুফয়ান ইবনু উয়াইনা রহ. (১০৭-১৯৮হি.) একবার কোনো একটি কথার কারণে রাগ করে বলে ফেললেন,
«لقد هممت أن لا أحدثكم شهرا».
আমি ভেবেছি একমাস তোমাদের সাথে কথা বলব না।
একথা শুনে এক ছাত্র বলে উঠল,
«يا أيا محمد ألِن جانبك، وحسّن قولك، وتأسٌ بصالحي سلفك، وأجمل مجالسة جلسائك، فقد أصبحت بقية النّاس وأمينا لله ولرسوله على العلم.
হে আবু মুহাম্মদ, নম্রতা অবলম্বন করুন! সুন্দরভাবে কথা বলুন! নেককার পূর্বসূরিদের আদর্শ গ্রহণ করুন এবং আপনার সাথে ওঠাবসাকারীদের সাথে সুন্দর আচরণ করুন! আপনি তো পূর্ববর্তীদের অবিশিষ্ট ব্যক্তি। আপনি আল্লাহ ও তার রাসুলের ইলমের রক্ষক।
ইমাম ইবনু উয়াইনা রহ. সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে গেলেন এবং কেঁদে কেঁদে এই পংক্তি আবৃত্তি করলেন,
خلت الديار فسدت غير مسود
ومن البلاء تفردي بالسود
বসতি খালি হয়ে গেল। তাই সর্দার বানানো ছাড়াই সর্দার হয়ে গেলাম । আমার এই একক সর্দারি আমার জন্য এক পরীক্ষা।
অতপর আবার ছাত্রদেরকে পড়ানো শুরু করে দিলেন।
_____
সূত্র, শায়েখ আবদুল কাদের মাগরিবি কৃত মুকাদ্দামাতুল হুকুক।
২৬।
একজন আদর্শ শিক্ষক কিতাব বা সিলেবাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক-ই ঢং ও পদ্ধতিতে পড়ান। এজন্যে তিনি বছরের শুরুতে সম্পূর্ণ কিতাবের পৃষ্ঠাসংখ্যা, ক্লাসসংখ্যা ও কোন বিষয় বিস্তারিত বলবেন এবং কোন বিষয় সংক্ষেপে বলবেন তার একটা খসড়া তৈরি করে নেন।
২৭।
আদর্শ শিক্ষক কখনো দারস বা ক্লাসে বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে আলোচনা করেন না। তবে বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আলোচনার প্রয়োজনে কখনো দূরে সরে গেলেও অনর্থক কথন এড়িয়ে চলেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকের ক্ষেত্রেই দেয়া যায়, তার আলোচনা চলতে থাকে বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মকেন্দ্রিক—যা সাধারণত অনর্থক হয়ে থাকে। এসব অনর্থক আলোচনার ফলে ছাত্রদের তেমন কোনো উপকার তো হয়-ই; বরং, ক্ষেত্রবিশেষ ছাত্রদের মাঝে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
২৮।
শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা হলো আমানত স্বরূপ। আর আমানতের খেয়ানত করা সম্পূর্ণ অনুচিত।
এর অর্থ হচ্ছে,
ছাত্ররা যখন শিক্ষকের কাছে পড়তে আসে তখন তাদের মন-মস্তিষ্ক থাকে সম্পূর্ণ খালি। একটি শূন্য পাত্রের মত। ফলে, শিক্ষক যা পাত্রে রাখবেন ছাত্র তা-ই অর্জন করবে। যদি শিক্ষক আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বত ও ভালোবাসা, দীনের সঠিক সমজ ছাত্রের মন ও মস্তিষ্কে দিতে সক্ষম হন তাবে ছাত্রের জীবন কামিয়াব হয়ে যাবে। আর যদি শিক্ষক ছাত্রকে এমন দর্শনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন—যা অনুসরণ করলে ছাত্র বিপথগামী হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে—তবে শিক্ষক আমানতের খেয়ানত করলেন। এর জন্য শিক্ষককে আল্লাহর সামনে হিসেবের সম্মুখীন হতে হবে।
সুতরাং, আমানতের প্রধান উদ্দেশ্য হলো- শিক্ষক যে বিষয় পড়াবেন তা খুব মুহাব্বত, মেহনত ও আগ্রহের সাথে পড়াবেন।
২৯।
একজন আদর্শ উস্তায যথাসম্ভব শিক্ষাকেন্দ্রিক তথা কিতাব পড়ানো ও ইজাফি মুতালাআয় দিনের পূর্ণ সময় কাটানোর চেষ্টা করেন। একাধিক বিষয়ের পিছনে ছোটেন না। আর যে উস্তাজ একাধিক বিষয় নিয়ে পড়ে থাকেন যেমন- মোবাইল, ফেসবুক, বিভিন্ন সভাসমিতিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি। এসব ব্যস্ততার কারণে তিনি মুতালাআয় উল্লেখযোগ্য তেমন সময় দিতে পারেন না। ফলে তার ক্লাস তেমন উপকারী হয় না। এবং ছাত্ররাও তার থেকে তেমন ফায়দা অর্জন করতে পারে না। এজন্য একজন আদর্শ শিক্ষক সর্বদা শিক্ষাকেন্দ্রিক থাকবেন।
৩০।
দারসের মাঝে তালিবুল ইলম বা ছাত্রদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিবেন। ওস্তাদ সবক পড়ানোর শেষ পাঁচ মিনিট ছাত্রদের প্রশ্ন করার জন্য বরাদ্দ রাখবেন। যাতে করে ছাত্রদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারে। কোন আলোচনা বুঝে না আসলে প্রশ্ন করে সমাধান করে নিতে পারে। এর ফলে দারসেই ছাত্রদের যে সমস্যা থাকে তার অধিকাংশ সামাধান হয়ে যায়। এবং এর মাধ্যমে ওস্তাদ ও ছাত্রদের মাঝে ইফাদা ও ইস্তেফাদা-এর সম্পর্ক তৈরি হয়। এবং অনেক নতুন বিষয় সামনে এসে যায়। সুতরাং ছাত্রদের জন্য প্রশ্ন করবার সুযোগ রাখতে হবে। তাছাড়া প্রশ্ন হল জ্ঞানের অর্ধেক। উত্তরের মাধ্যমে এর পূর্ণতা পায়।
মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্রদের মাঝে আলহামদুলিল্লাহ আদব-কায়দা বেশি থাকার ফলে ছাত্ররা ওস্তাদকে প্রশ্ন করতে বিব্রত বোধ করে। তারা ভাবে, আমার প্রশ্নের দ্বারা ওস্তাদ কষ্ট পেয়ে যান কিনা! কিংবা কোন বেয়াদবি হয়ে যায় কিনা! কোনো কোনো ওস্তাদ আছেন প্রশ্ন করতেই নিষেধ করে দেন। অথচ উচিত ছিল ছাত্রদের প্রশ্ন করবার সুযোগ দেওয়া। ছাত্রদের জন্য ইস্তেফাদা-এর সুযোগ রাখা।
ছাত্ররা যে প্রশ্ন করে তা সাধারণত তিন প্রকার হয়ে থাকে :
০১. কিছু ছাত্র বাস্তবিক পক্ষেই সবক না বুঝার ফলে ওস্তাদের কাছে সবক বুঝতে প্রশ্ন করে।
০২. কিছু ছাত্রের মাথায় সন্দেহ জাগ্রত হয়। তার পূর্বের জানা আর বর্তমান পড়ার মাঝে খটকা লাগার কারণে প্রশ্ন করে সমাধান করতে চায়।
০৩. কিছু ছাত্র আছে যারা দুষ্টামি করে। শিক্ষককে নিশ্চুপ ও থামিয়ে দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করে থাকে।
একজন আদর্শ শিক্ষকের কাজ হল এ তিন প্রকার ছাত্রের প্রশ্নের উত্তরই অত্যন্ত নরম ও ভালবাসার সাথে দেওয়া। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকের জানা না থাকে তবে অকপটে বলে দেওয়া, এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমি মোতালাআ করে কিংবা কোনো বিশেষজ্ঞ থেকে জেনে তোমাদের জানাবো।
মনে রাখা উচিত,
আমি জানিনা বলাটা কোন দোষের নয়। ভুল উত্তরের কারণে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে সঠিক উত্তরের দ্বারা নয়। আমি জানিনা কথার দ্বারা সম্মান কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে ভুল উত্তরের মাধ্যমে সম্মান কমে। ওস্তাদের উপর ছাত্রদের বিশ্বাস কমে যায়। সুতরাং আমি জানিনা অকপটে স্বীকার করে নেওয়াটাই শ্রেয়।
ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহকে ৪০টি প্রশ্ন করা হলে তিনি ৩৬টির উত্তরেই বলেছেন আমি জানিনা। বাকি মাত্র চারটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। (আল বাহরুল মুহিত ফি উসূলিল ফিকহ : ১/২৩৮)